ওষুধ, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, জুস, ফলমূল, সাবান, মিষ্টিসহ ৬৫ পণ্যে ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ ছাড়া মোবাইলে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারের খরচেও বাড়তি ভ্যাট বসানো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য আইনে কিছু সংশোধন আনা হয়েছে।
এসব সংশোধনীসহ মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২৫–এর খসড়া সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে বুধবার (১ জানুয়ারি) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। অচিরেই তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারকে দেওয়া ঋণের শর্ত হিসেবে কর ছাড় কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর অংশ হিসেবে ভ্যাটহার যৌক্তিক করার কথা বলেছে। সংস্থাটির পরামর্শমতে, মানুষের প্রতিদিন ব্যবহার্য ৬৫টি পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।
তালিকায় উল্লেখযোগ্য পণ্যগুলো হলো জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ/সস, সিগারেট, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পল (স্যান্ডেল), বিমান টিকিট ইত্যাদি।
তবে ভ্যাট বাড়ানোর কারণে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, ঋণ দিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে; টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটির বেশি। এই অর্থ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার (চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা) সঙ্গে যোগ হবে।
বাজেট প্রণয়নের সময় এনবিআরকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এই লক্ষ্য বাস্তবভিত্তিক নয় বলে এনবিআর থেকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। তার ওপর আইএমএফ আরও ১২ হাজার কোটি টাকা আদায়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় ভ্যাট হার বাড়ানোর বিকল্প ছিল না।
সূত্র আরও জানায়, উপদেষ্টা পরিষদ নতুন ভ্যাটহারের বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত বাজেটের সময়ই ভ্যাটের হার বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর বাইরে খুব একটা পরিবর্তন হয় না। তা ছাড়া মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে এবার তো তা করার তেমন কারণও নেই। অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে এনবিআর ভ্যাটহার বাড়াতে চায়নি।
এমনিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এনবিআর চাল, চিনি, ভোজ্য তেলসহ সাতটি পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড় দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ঋণ পেতে কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে এবং অতিরিক্ত সেই অর্থ আদায় করতে হবে বাজেট-পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। তাই মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট বাড়ানো ছাড়া এনবিআরের আর কোনো উপায় ছিল না।
গত বছরের ৪ ও ৫ ডিসেম্বর এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর খাতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। এতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশে আইএমএফ মিশনের প্রধান জয়েন্দু দে। বৈঠকে আইএমএফ কর অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে আনার জন্য চাপ দেয়। একই সঙ্গে বাজেট পদক্ষেপের মাধ্যমে কর-জিডিপি অনুপাত আগের শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশের অতিরিক্ত আরও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত জুড়ে দেয়।
জানা যায়, ক্ষমতার পালাবদলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে একধরনের মন্দাভাব থাকায় কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এরই মধ্যে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির মুখে সরকার। তাই রাজস্ব আয় বাড়াতে বিভিন্ন উপায় খুঁজছে এনবিআর। এরই অংশ হিসেবে ভ্যাট বাড়ানোর এ কৌশল বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
এনবিআরের এক সদস্য জানান, আইএমএফের শর্ত পূরণে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট খাতে বড় পরিবর্তনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মূলত আইএমএফ অর্থ বিভাগকে শর্ত দিয়েছে। অর্থ বিভাগ আমাদের (এনবিআর) পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে বলেছে। আইএমএফের শর্তানুযায়ী, ভ্যাট খাতে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়তি আদায় করতে হবে। অর্থাৎ বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করতে হবে। আমরা কয়েকটি খাতে ভ্যাট বাড়ানো, কোথাও হ্রাস এবং কোথাও কোথাও যৌক্তিকীকরণের পরিকল্পনা প্রস্তাব প্রতিবেদন তৈরি করেছি। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রস্তাব প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে ৪ জানুয়ারি অধ্যাদেশ জারি হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যে বা সাধারণ মানুষের প্রভাব পড়ে এমন কোনো পণ্য বা সেবায় ভ্যাট বা সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। বরং বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে বাজেটের পর বেশ কয়েকবার ভ্যাট ও শুল্ক কমানো হয়েছে।