মালতীর বয়স ৭০ না ৭৫, ঠিকঠাক বলতে পারেন না। পাতলা লিকলিকে শরীরে ভিক্ষা করে বেড়ান। স্বামী রবিন মন্ডলের বয়স ৮০-র অধিক, নানা রকম রোগ নিয়ে কাজ করার মতো বল পান না শরীরে। এক ছেলে, ছেলে বউ, ডিভোর্সি মেয়ে, তিন নাতি-নাতনি আর স্বামীকে নিয়ে সংসার। ছেলে শূকর চরানোর কাজ করে মাসে ৫ হাজার টাকা পায়। এই টাকায় না সংসার চলে, না চলে বাচ্চাদের পড়ালেখা। বুড়ো-বুড়ির খাওয়া-ওষুধ তো অনেক পরের কথা।
মালতী বলেন, নিজেরা পড়াশোনা করেননি। সে সময় সমাজে ছোট জাত (কায়পুত্র) বলে পড়াশোনার অধিকারও ছিল না। তবে এখন যে যুগ পড়েছে, তাতে পড়াশোনা না করলে একটু ভালো থাকা যায় না, তাই ভিক্ষে করেই নাতির পড়ার খরচ অনেকটাই চালান। ভর্তি আর বই-খাতা বাবদ এককালীন ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়েছেন বলে জানান। এছাড়া যখনই টান পড়ে, তখনই মালতী নাতির পড়ার খরচ দিতে পিছপা হন না।
ভিক্ষা করে কত পান? জানতে চাইলে জানান, প্রতিদিন ২৫ বা ৫০, কোনো দিন ১০০-ও হয়, তবে সেটা খুব কম। তবে কয়েক কেজি চাল জোটে। সরকার তো ৬০ বছরের অধিক বয়সী নারীর জন্য বয়স্কভাতা দেয়, ভাতা পান কি না, জানতে চাইলে জানান—‘মোরা কেউ ভাতা পাইনে। মোরা ভিক্ষে করেই খাই।’ মালতীর সঙ্গে কথা হয় সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নে। দিনের পর দিন সমাজের তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার এই জনগোষ্ঠী সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীর আওতায় আসেনি।
স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম থাকলেও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, এমন অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তথ্য তাদের কাছে নেই। আবার তাদের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে লোকবলের অভাব আছে। জানা যায়, এলাকার দু/চার জন যারা ভাতা পান, তারাও সেই ভাতার টাকা হাতে নিতে পারেন না। দুষ্টচক্র হাতিয়ে নেয় টাকা। এমন বাস্তবতার মধ্যে আজ ১ অক্টোবর ‘মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য: বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’ প্রতিপাদ্যে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস।
অধিকাংশ প্রবীণের পেশা ভিক্ষা :শ্যামনগর উপজেলার সাহেবখালী ইউনিয়নে কথা হয় শতবর্ষী মিনি দাসীর সঙ্গে। গলার ও গায়ের জোর একই সঙ্গে কমছে। জানান, তার ভিক্ষা চাইতে হয় না, মানুষের সামনে হাত বাড়ালেও দুই/পাঁচ টাকা আসে। ছেলে, ছেলের বউয়ের সঙ্গে থাকেন। সরকার যে ভাতা দেয়, তা তাদের জন্য নয় বলে মন্তব্য করেন। মালতী জানান, প্রতিদিন ভিক্ষা করে পাঁচ থেকে ছয় কেজি চাল জোটে তার। আলীপুরে ৭০ বছরের কল্যাণীও ভিক্ষা করেন। ঝড়-বৃষ্টি যা-ই হোক, তাকে বের হতে হবে ভিক্ষে করতে।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান, এই জনগোষ্ঠীকে (কায়পুত্র) এখনো মানুষ সেভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। তাদের পেশা শূকর পালন, তাই তারা দরিদ্র হলেও তাদের কেউ গৃহশ্রমিক হিসেবেও কাজে নেয় না। ফলে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। তবে তারা এবং স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাদের সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছেন।
ভাতার টাকা আসে না হাতে :এলাকায় ‘কোর সাপোর্ট মডেল’ প্রকল্পের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে ‘ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্স’। প্রতিষ্ঠানের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের ধারণা বদলায়নি, তাই অনেক রকম সুবিধাবঞ্চিত হন তারা। ২০২৩ সালে তারা সাতক্ষীরা এলাকার ১১৪ জন প্রবীণ ব্যক্তির বয়স্কভাতার কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। তবে তাদের কেউ কেউ ভাতা পান। যারা ভাতা পান, তাদের একজন সুবাস মুন্ডা অভিযোগ করে জানান, টাকা পাওয়ার আগেই তার মোবাইল থেকে টাকা অন্য কেউ নিয়ে যায়। তাই তিনি ভাতার টাকা হাতে পান না।
ভুক্তভোগীরা মনে করেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের ব্যক্তিবর্গ এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। এসব বিষয় নিয়ে সাতক্ষীরা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. তারিকুল ইসলাম জানান, সামাজিক নিরাপত্তাসেবা পেতে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের ভোটের জন্য তৎপর থাকলেও তাদের ভাতার সুযোগ-সুবিধা অন্যদের দেওয়ার পরই দেয়। আবার তারা তথ্যপ্রযুক্তিতে অতটা অগ্রসর না হওয়ায় নিজেরাও পিছিয়ে থাকে। ভাতার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, দুষ্টচক্র সব সময় সক্রিয় থাকে। ভাতা যাওয়ার আগেই তাদের কাছে ফোন দেয়, ওটিপি ও পিন নাম্বর জেনে টাকা হাতিয়ে নেয়।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আকার বাড়ছে, তার পরও এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কেন ভাতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল ইত্তেফাককে বলেন, ৬০ লাখ ১ হাজার প্রবীণ ব্যক্তি বয়স্কভাতা পান। তবে প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর তথ্য তাদের কাছে নেই। তাছাড়া তাদের জনবলের অভাব আছে। দুষ্টচক্রের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশের বাইরে সমাজসেবা অধিদপ্তর নয়, তাই এখানে কিছু দুষ্টলোক থাকতেই পারে। নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি অভিযোগ পেলে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।