সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ছোট কিংবা বড় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে এখন সারা দেশের জনগণের মনেই বহুতল ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিশেষ করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্নতা কাজ করছে। বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর বেশ কিছু ভবনে ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক অভিযান চালানো হয়। কিন্তু তারপর এ বিষয়ে আর কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। শুধু ঢাকা নয়- সারা দেশের অসংখ্য আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন যথাযথ নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করেই তৈরি করা হয়েছে। এমনকি ভবন নির্মাণের পর কোন ভবন কোন কাজে ব্যবহৃত হবে সেটির কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা অনুসরণ করা হচ্ছে না। আমরা লক্ষ্য করেছি, বেইলি রোডের অগ্নিদুর্ঘটনার পর অনেক লেখালেখি ও টকশোতে আলোচনার পর অভিযান হয়েছে; কিন্তু তারপর আর কোনো অভিযান পরিচালনার কোনো খবর আমাদের সামনে আসেনি। আমাদের মনে প্রশ্ন উঠেছে, কেন অভিযান থেমে গেল? আবার কি কোনো দুর্গটনার পর অভিযান শুরু হবে?
প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়। পুড়ে কয়লা হয় বহু প্রাণ। সন্তানহারা হন মা, অকালে বিধবা হন পত্নী, পিতার কাঁধে ওঠে সন্তানের পোড়া লাশ। মর্মান্তিক এসব কেবল অসতর্কতার খেসারত, যা দেশ ও জাতির জন্য চরম ক্ষতির কারণ। আমরা একটু সচেতন হলেই এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলতে পারি। আমাদের দেশে বহুবার অগ্নিদুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় সবারই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। একটু সচেতন হলেই অনেক বড় দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত কিংবা ক্ষতির হার কমানো সম্ভব হতো। আমরা যদি সচেতন না হই বা সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা না করি তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে।
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীর আগুন থেকে শুরু করে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড চিত্রটি একই। কিন্তু সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হচ্ছে না। অফিস-আদালতে এবং তৃণমূল পর্যায়ে ঘুষ, দুর্নীতির প্রভাবে ভেঙে পড়েছে সকল সরকারি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো। সরকারের উচ্চমহলের আন্তরিকতা থাকলেও ফুল টাইম রাজনীতিক ক্যাডার এবং সরকারি কর্মকতা-কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য যথাযথ এবং প্রত্যাশিত ফলাফল ঘরে তুলতে পারা যাচ্ছে না। বেইলি রোডের আটতলা ভবন গ্রিন কোজি কটেজে আগুনে ৪৫ জনের মৃত্যুর পর সামনে এসেছে নানা ধরনের গাফিলতির চিত্র। এটা শুধু এবারই নয়, এর আগেও এ ধরনের গাফিলতি আমাদের সামনে এসেছে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে যে মামলা করেছে তার এজাহারে বলা হয়েছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দোকান পরিদর্শকদের ‘ম্যানেজ’ করে ভবনে অবৈধভাবে রেস্তোরাঁ পরিচালনা করা হচ্ছিল। এ ছাড়া গণমাধ্যমসূত্রে জানতে পারলাম ১১টি কর্তৃপক্ষ যেসব অনুমতি দিয়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় পরিচালনার সুযোগ দেয়, তারাও নানা ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। অথচ সরকারপ্রধান দীর্ঘদিন থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। নানা ধরনের সিন্ডিকেট সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিদর্শনে ভবনে অগ্নিঝুঁকির চিত্র নিয়মিতই বেরিয়ে আসে। যেমন ২০২৩ সালে তারা সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭৪টি ভবন পরিদর্শন করে। এর মধ্যে ২ হাজার ১১৮টি ভবনে ঝুঁকি খুঁজে পায়। ৪২৪টি ভবনকে তারা অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে। ঢাকায় বিগত পাঁচ বছরে হওয়া অন্তত ৯টি বড় অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দুর্ঘটনার পর তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা নিজেদের দায় অন্য সংস্থার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার তদন্তে সরকারি সংস্থার গাফিলতির চিত্র উঠে আসে। কিন্তু তাদের ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া হয়। এমনকি আইনের কিছু দুর্বলতার কারণেও এ ধরনের দুর্ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিস কেন শুধু চিঠি দেয়, কেন ভবন সিলগালা করা হয় না, সেটা সাংবাদিকরা সম্প্রতি জানতে চেয়েছিল সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে। তিনি বলেন, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইনে (২০০৩) তাদের মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে বিধিমালা স্থগিত আছে। এ কারণে চিঠি দেওয়া ছাড়া তাদের করার কিছু থাকে না। তিনি বলেন, ব্যবস্থা নিতে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়। অনেক বিপণিবিতান আছে ঝুঁকিপূর্ণ, যেগুলো ভেঙে ফেলা প্রয়োজন। কিন্তু ভবন না ভাঙার বিষয়ে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা নিয়ে আসে বিপণিবিতানের দোকান মালিক সমিতি। ফলে সেখানে কিছু করার থাকে না। তিনি বলেন, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ভাঙতে গিয়েও সিটি করপোরেশন একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল।
বেইলি রোডে আগুনেও সিটি করপোরেশনের দায় রয়েছে বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, অনুমোদন ছাড়া ভবনজুড়ে রেস্তোরাঁ ও দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে। দক্ষিণ সিটির সিইও বলেন, ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় নাগরিকদের সেবাটা যেন সহজ হয় সেটা চিন্তা করা হয়। চুক্তিপত্র ও সাধারণ কয়েকটি বিষয় দেখে ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হয়। এখানেই বড় প্রশ্ন যে সাধারণ একজন ব্যবসায়ী কী ব্যবসা পরিচালনা করবেন, কেন অনুমতি দেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে কোনো তদারকি ছাড়াই। এতেই প্রমাণিত হয় যে এ বিষয়টি এক ধরনের ‘মিউচুয়াল করাপশন’-এর মধ্য দিয়ে সংঘটিত হচ্ছে। মানবজীবনে দুর্ঘটনা সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। প্রাকৃতিক কিংবা দৈববলেই বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। সেই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলাও করতে হয়; কিন্তু যখন কোনো দুর্ঘটনা নিজেদের উদাসীনতার কারণে সংঘটিত হয় এবং এর পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে তখন তা একটি জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনকই বটে। ক্ষয়ক্ষতি যেমনই হোক না কেন আগুন কিন্তু সব সময় মারাত্মক। জীবন-যাপনে কোনো কাজেই সচেতনতার বিকল্প নেই। প্রতিটা কমার্শিয়াল ভবনে ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট রাখা দরকার; কিন্তু কয়টি ভবনে যথাযথ নিয়ম-কানুন মানা হচ্ছে। বাংলাদেশে শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়- অন্যান্য শহরেও কি যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে বেশির ভাগ শহরেই বহু ভবন এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ন্যূনতম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই।
ইতোপূর্বে অন্যান্য অগ্নিদুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসবের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, পরিকল্পিতভাবে কেমিক্যাল শিল্পজোন গড়ে তুলে পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া এবং দাহ্য কেমিক্যাল আনা-নেওয়া বন্ধ, সেখানে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলাসহ ভবন নির্মাণ এবং মার্কেট ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি এ বিষয়ে বারবার হুঁশিয়ারি এবং সচেতন করতে বক্তব্য এবং নির্দেশনা দিয়েছেন। পরিতাপের বিষয় হলো, বিগত সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সেসব নির্দেশনার কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।