আজ বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
Logo অভিযান সত্ত্বেও বন্ধ নেই ইলিশ নিধন Logo এসিড সারভাইভরা সমাজের বোঝা নয়, তারা এখন নিজ ব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে Logo সাতক্ষীরা জামায়াতের নবনির্বাচিত আমির অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম মুকুলের শপথ গ্রহণ Logo পল্টন ট্রাজেডি দিবস উপলক্ষে সাতক্ষীরায় আলোচনা সভা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী Logo সাতক্ষীরায় সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন নগর গড়ে তোলার দাবিতে মানববন্ধন Logo সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার তথ্য আহ্বান Logo আরও ছয়জনসহ ডেঙ্গুতে চলতি বছরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৭৭ Logo শ্যামনগরে বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে এক নারী নিহত Logo সাংবাদিক অসীম বরণ চক্রবর্তীর মৃত্যুতে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের শোক Logo সাতক্ষীরায় স্কুলে স্কুলে চলছে এইচপিভি ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন
বিজ্ঞাপন দিন
জাতীয়, আঞ্চলিক, স্থানীয় পত্রিকাসহ অনলাইন পোর্টালে যে কোন ধরনের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন। মেসার্স রুকাইয়া এড ফার্ম -01971 211241

অগ্নিঝরা মার্চ

  • রিপোর্টার
  • আপডেট সময়: ০৪:২৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
  • ১০৩ বার পড়া হয়েছে

১৯৭১-এর ১৯ মার্চ । লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস। স্বাধিকারকামী অসহযোগ আন্দোলনের ধারাক্রমে প্রবীণ-নবীন নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নেমেছে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২নং বাসভবনে। বাসভবনটি যেন বাংলার মুক্তিকামী মানুষের তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ভোর থেকে গভীর রাত অবধি শত শত মিছিলের লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে শ্লোগানে মুখরিত নেতার বাসভবনের সম্মুখ প্রাঙ্গণ। শপথ দৃপ্ত ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, কর্মচারী, শ্রমিক, কৃষক, নার্স, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের সংগঠনসমূহ অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপনপূর্বক নেতার আশীর্বাদ কামনা করেন। নেতার বাসভবনে সমাগত বিদেশী সাংবাদিকদের এসব মিছিলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবেগভরা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিদেশী বন্ধুরা দেখুন। আমার দেশের মানুষ আজ প্রতীজ্ঞায় কী অটল, সংগ্রাম আর ত্যাগের মন্ত্রে কত উজ্জীবিত। কার সাধ্য এদের রোখে? আমার দেশ আজ জেগেছে, জনগণ আজ জেগেছে। জীবন দিতে শিখেছে। স্বাধীনতার জন্য জীবনদানের অগ্নিশপথে দৃপ্ত জাগ্রত জনতার এ জীবন জোয়ারকে, প্রচণ্ড এ গণবিস্ফোরণকে স্তব্ধ করতে পারে এমন শক্তি মেশিনগানেরও আজ আর নেই। ভোর ৫টা হতে রাত পর্যন্ত আপনারা কেবল একই দৃশ্য দেখতে পাবেন। বাসভবনে আগত একের পর এক মিছিলে জনতার উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রত্যয়দৃপ্তভাবে মুক্তি সংগ্রামের পতাকা আরও ঊর্ধে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে আপামর বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু জলদ গম্ভীর স্বরে বলেন, বাংলার মানুষ তোমরা ঘরে ঘরে সংগ্রামের দুর্গ গড়ে তোল। আঘাত যদি আসে, প্রতিহত করো, পাল্টা আঘাত হানো। ৭ কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালীর সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও আমরা লক্ষ্যে পৌঁছবই। দরকার হলে রক্ত দিয়েই আমরা দাবি প্রতিষ্ঠা করব। তবু শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দাবি আদায় শান্তিপূর্ণভাবে হলে ভাল নইলে সংগ্রামের দুর্গম পথ ধরেই আমরা লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌঁছব। নার্সিং স্কুলের ছাত্রীদের এক বিশাল মিছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে সমবেত হয়ে গগনবিদারী স্বাধীনতার øোগান দিতে থাকলে বঙ্গবন্ধু নিজেই করতালি দিয়ে মিছিলটিকে স্বাগত জানিয়ে জয় বাংলা øোগান দিয়ে তাদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা স্বাধীনতা পাবে। এ সময় কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিকের একটি গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করতে আসেন। নেতাও স্বল্পসময়ের জন্য সাক্ষাতকার দেন। একজন প্রশ্ন করেন, মি. ভুট্টো কি ঢাকা আসছেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি জানি না। অপর একজন জিজ্ঞাসা করেন, আপনার কাছে কি এমন কোন খবর আছে যে, এখানে আরও সৈন্য এসে পৌঁছেছে? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে যা কিছুই ঘটে সব খবরই আমি রাখি। এদিকে গত ২ মার্চ হতে ৯ মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কি পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সামরিক বাহিনীকে ডাকা হয়েছিল তার তদন্তের জন্য খ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক ৫ সদস্যবিশিষ্ট যে কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, এহেন তদন্ত কমিশন আমরা চাই নাই। আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত। সেহেতু, সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত কমিশনের সঙ্গে কোনরূপ সহযোগিতা না করার জন্য তিনি সকলের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, আমি দুঃখিত যে তদন্ত কমিশনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে সেটি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ হতে উত্থাপিত আমার দাবির পরিপূরক নয়। একটি সামরিক নির্দেশ বলে এই সামরিক কমিশন গঠন এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছেই এর রিপোর্ট দাখিলের বিধান অত্যন্ত আপত্তিকর। কমিশনের বিবেচ্যসূচীই মূল ইস্যুর পূর্বাহ্নিক বিচার এবং আসল ইস্যুর তদন্ত না করার মতলব ফাঁস করে দিয়েছে। একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মার্চ মাসের ২ তারিখ থেকে ৯ তারিখের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় যে পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল তা নির্ধারণ করা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই সেনাবাহিনী তলব ও শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল কি-না তা তদন্ত করতে হবে বিধায় মূল বিষয় সম্পর্কে শুনানির আগেই বিচার করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে সব নির্যাতনমূলক কার্যকলাপে হাজার হাজার লোক হতাহত হয়েছে সে সম্পর্কেও তদন্ত করার এখতিয়ার তদন্ত কমিশনকে দেয়া হয়নি। আর তাই কতজন মারা গেছে, কী পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করা হযেছে সেটিও তদন্ত করে দেখা যাবে না। এহেন কমিশনের দ্বারা কোন ফলপ্রসূ লক্ষ্য হাসিল হতে পারে না। বস্তুত, এটি মোটেই সত্যে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি যথাযথ তদন্ত হবে না। হবে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার একটি ফন্দি মাত্র। তাই আমরা এ কমিশন মেনে নিতে পারি না। বাংলাদেশের জনগণ কোন প্রকারেই এ ধরনের কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না। কেউ এ কমিশনে কোন সদস্য মনোনীত করবেন না এবং কেউ এর অধীনে কাজ করবেন না। জনগণের পক্ষ হতে আমরা গত ৭ মার্চ ৪ দফা দাবি তুলেছি। এর একটি দাবি ছিল যথাযথ বিবেচ্যসূচীসহ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত অনুষ্ঠান। সে দাবিগুলোর নামমাত্র বা খণ্ডিত স্বীকৃতি তাও উল্লিখিত পদ্ধতিতে আমাদের সামনে বিরাজমান গভীর সঙ্কট সমাধানে কিছুমাত্র সহায়ক হবে না। সামরিক সরকার কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশন দেশের সকল মহল কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। সকল রাজনৈতিক মহল থেকে কমিশন প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এদিকে গত মঙ্গলবার ও বুধবার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও আজ কোন বৈঠক হয়নি। তবে আগামীকাল পুনরায় তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া আজ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কয়েক শত লোক মিছিল সহকারে এসে এই মর্মে অভিযোগ করেন যে, গত কয়েকদিন যাবত সেনাবাহিনীর সদস্যরা যশোর, খুলনা, রাজধানী ঢাকার মহাখালী এসব জায়গায় সাধারণ মানুষের ওপর জোর-জুলুম করে মারধর করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে। বিনা উস্কানিতে সেনাবাহিনীর এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা এবং দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, কোনরূপ উস্কানিমূলক আচরণ যে মহলই করুক না কেন তা সহ্য করা হবে না এবং এর দায়-দায়িত্ব সম্পর্ণভাবে উস্কানিদাতাদেরই বহন করতে হবে। এদিকে নিউজ পেপার প্রেস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েমের লক্ষ্যে সকল বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রস্তুত হওয়ার জন্য দেশের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি আহ্বান জানায়। প্রাক্তন বৈমানিকগণ শহীদ মিনারে এক প্রতিবাদসভায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো অসহযোগ চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এদিনে মিছিল এবং প্রতিবাদ সমাবেশের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বিপুলসংখ্যক নারীদের উপস্থিতি। আজ চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে আগত ৪৩ হাজার টন গম বহনকারী আরেকটি জাহাজ গতিপথ পরিবর্তন করে অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে চলে গেছে। এমন সংবাদে স্পষ্টই বোঝা যায় আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে খাদ্যের বদলে সৈন্য এবং অস্ত্র আগমনের জেনারেল ইয়াহিয়ার আসল উদ্দেশ্য কী? সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারী ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলিত রেখে এবং অফিস-আদালতে যোগদানে বিরত থেকে বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষ অসহযোগকে সফল করে তুলেছে। ঢাকার রাজপথ বিক্ষোভকারী জনতার পদভারে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলন এবং কর্মসূচীর প্রতি রাজনৈতিক মতভেদ নির্বিশেষে সকল প্রতিষ্ঠান, সকল শ্রেণীর মানুষ সংঘবদ্ধভাবে অকুণ্ঠচিত্তে এককণ্ঠ হয়ে সমর্থন এবং তার নির্দেশকে বাস্তবায়ন করার জন্য মিছিল, সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে যেভাবে শপথ এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করছে তাতে আসন্ন সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

ট্যাগস:

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

অভিযান সত্ত্বেও বন্ধ নেই ইলিশ নিধন

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com

অগ্নিঝরা মার্চ

আপডেট সময়: ০৪:২৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

১৯৭১-এর ১৯ মার্চ । লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস। স্বাধিকারকামী অসহযোগ আন্দোলনের ধারাক্রমে প্রবীণ-নবীন নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নেমেছে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২নং বাসভবনে। বাসভবনটি যেন বাংলার মুক্তিকামী মানুষের তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ভোর থেকে গভীর রাত অবধি শত শত মিছিলের লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে শ্লোগানে মুখরিত নেতার বাসভবনের সম্মুখ প্রাঙ্গণ। শপথ দৃপ্ত ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, কর্মচারী, শ্রমিক, কৃষক, নার্স, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের সংগঠনসমূহ অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপনপূর্বক নেতার আশীর্বাদ কামনা করেন। নেতার বাসভবনে সমাগত বিদেশী সাংবাদিকদের এসব মিছিলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবেগভরা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিদেশী বন্ধুরা দেখুন। আমার দেশের মানুষ আজ প্রতীজ্ঞায় কী অটল, সংগ্রাম আর ত্যাগের মন্ত্রে কত উজ্জীবিত। কার সাধ্য এদের রোখে? আমার দেশ আজ জেগেছে, জনগণ আজ জেগেছে। জীবন দিতে শিখেছে। স্বাধীনতার জন্য জীবনদানের অগ্নিশপথে দৃপ্ত জাগ্রত জনতার এ জীবন জোয়ারকে, প্রচণ্ড এ গণবিস্ফোরণকে স্তব্ধ করতে পারে এমন শক্তি মেশিনগানেরও আজ আর নেই। ভোর ৫টা হতে রাত পর্যন্ত আপনারা কেবল একই দৃশ্য দেখতে পাবেন। বাসভবনে আগত একের পর এক মিছিলে জনতার উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রত্যয়দৃপ্তভাবে মুক্তি সংগ্রামের পতাকা আরও ঊর্ধে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে আপামর বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু জলদ গম্ভীর স্বরে বলেন, বাংলার মানুষ তোমরা ঘরে ঘরে সংগ্রামের দুর্গ গড়ে তোল। আঘাত যদি আসে, প্রতিহত করো, পাল্টা আঘাত হানো। ৭ কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালীর সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও আমরা লক্ষ্যে পৌঁছবই। দরকার হলে রক্ত দিয়েই আমরা দাবি প্রতিষ্ঠা করব। তবু শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দাবি আদায় শান্তিপূর্ণভাবে হলে ভাল নইলে সংগ্রামের দুর্গম পথ ধরেই আমরা লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌঁছব। নার্সিং স্কুলের ছাত্রীদের এক বিশাল মিছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে সমবেত হয়ে গগনবিদারী স্বাধীনতার øোগান দিতে থাকলে বঙ্গবন্ধু নিজেই করতালি দিয়ে মিছিলটিকে স্বাগত জানিয়ে জয় বাংলা øোগান দিয়ে তাদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা স্বাধীনতা পাবে। এ সময় কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিকের একটি গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করতে আসেন। নেতাও স্বল্পসময়ের জন্য সাক্ষাতকার দেন। একজন প্রশ্ন করেন, মি. ভুট্টো কি ঢাকা আসছেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি জানি না। অপর একজন জিজ্ঞাসা করেন, আপনার কাছে কি এমন কোন খবর আছে যে, এখানে আরও সৈন্য এসে পৌঁছেছে? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে যা কিছুই ঘটে সব খবরই আমি রাখি। এদিকে গত ২ মার্চ হতে ৯ মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কি পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সামরিক বাহিনীকে ডাকা হয়েছিল তার তদন্তের জন্য খ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক ৫ সদস্যবিশিষ্ট যে কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, এহেন তদন্ত কমিশন আমরা চাই নাই। আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত। সেহেতু, সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত কমিশনের সঙ্গে কোনরূপ সহযোগিতা না করার জন্য তিনি সকলের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, আমি দুঃখিত যে তদন্ত কমিশনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে সেটি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ হতে উত্থাপিত আমার দাবির পরিপূরক নয়। একটি সামরিক নির্দেশ বলে এই সামরিক কমিশন গঠন এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছেই এর রিপোর্ট দাখিলের বিধান অত্যন্ত আপত্তিকর। কমিশনের বিবেচ্যসূচীই মূল ইস্যুর পূর্বাহ্নিক বিচার এবং আসল ইস্যুর তদন্ত না করার মতলব ফাঁস করে দিয়েছে। একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মার্চ মাসের ২ তারিখ থেকে ৯ তারিখের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় যে পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল তা নির্ধারণ করা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই সেনাবাহিনী তলব ও শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল কি-না তা তদন্ত করতে হবে বিধায় মূল বিষয় সম্পর্কে শুনানির আগেই বিচার করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে সব নির্যাতনমূলক কার্যকলাপে হাজার হাজার লোক হতাহত হয়েছে সে সম্পর্কেও তদন্ত করার এখতিয়ার তদন্ত কমিশনকে দেয়া হয়নি। আর তাই কতজন মারা গেছে, কী পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করা হযেছে সেটিও তদন্ত করে দেখা যাবে না। এহেন কমিশনের দ্বারা কোন ফলপ্রসূ লক্ষ্য হাসিল হতে পারে না। বস্তুত, এটি মোটেই সত্যে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি যথাযথ তদন্ত হবে না। হবে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার একটি ফন্দি মাত্র। তাই আমরা এ কমিশন মেনে নিতে পারি না। বাংলাদেশের জনগণ কোন প্রকারেই এ ধরনের কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না। কেউ এ কমিশনে কোন সদস্য মনোনীত করবেন না এবং কেউ এর অধীনে কাজ করবেন না। জনগণের পক্ষ হতে আমরা গত ৭ মার্চ ৪ দফা দাবি তুলেছি। এর একটি দাবি ছিল যথাযথ বিবেচ্যসূচীসহ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত অনুষ্ঠান। সে দাবিগুলোর নামমাত্র বা খণ্ডিত স্বীকৃতি তাও উল্লিখিত পদ্ধতিতে আমাদের সামনে বিরাজমান গভীর সঙ্কট সমাধানে কিছুমাত্র সহায়ক হবে না। সামরিক সরকার কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশন দেশের সকল মহল কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। সকল রাজনৈতিক মহল থেকে কমিশন প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এদিকে গত মঙ্গলবার ও বুধবার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও আজ কোন বৈঠক হয়নি। তবে আগামীকাল পুনরায় তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া আজ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কয়েক শত লোক মিছিল সহকারে এসে এই মর্মে অভিযোগ করেন যে, গত কয়েকদিন যাবত সেনাবাহিনীর সদস্যরা যশোর, খুলনা, রাজধানী ঢাকার মহাখালী এসব জায়গায় সাধারণ মানুষের ওপর জোর-জুলুম করে মারধর করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে। বিনা উস্কানিতে সেনাবাহিনীর এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা এবং দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, কোনরূপ উস্কানিমূলক আচরণ যে মহলই করুক না কেন তা সহ্য করা হবে না এবং এর দায়-দায়িত্ব সম্পর্ণভাবে উস্কানিদাতাদেরই বহন করতে হবে। এদিকে নিউজ পেপার প্রেস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েমের লক্ষ্যে সকল বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রস্তুত হওয়ার জন্য দেশের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি আহ্বান জানায়। প্রাক্তন বৈমানিকগণ শহীদ মিনারে এক প্রতিবাদসভায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো অসহযোগ চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এদিনে মিছিল এবং প্রতিবাদ সমাবেশের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বিপুলসংখ্যক নারীদের উপস্থিতি। আজ চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে আগত ৪৩ হাজার টন গম বহনকারী আরেকটি জাহাজ গতিপথ পরিবর্তন করে অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে চলে গেছে। এমন সংবাদে স্পষ্টই বোঝা যায় আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে খাদ্যের বদলে সৈন্য এবং অস্ত্র আগমনের জেনারেল ইয়াহিয়ার আসল উদ্দেশ্য কী? সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারী ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলিত রেখে এবং অফিস-আদালতে যোগদানে বিরত থেকে বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষ অসহযোগকে সফল করে তুলেছে। ঢাকার রাজপথ বিক্ষোভকারী জনতার পদভারে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলন এবং কর্মসূচীর প্রতি রাজনৈতিক মতভেদ নির্বিশেষে সকল প্রতিষ্ঠান, সকল শ্রেণীর মানুষ সংঘবদ্ধভাবে অকুণ্ঠচিত্তে এককণ্ঠ হয়ে সমর্থন এবং তার নির্দেশকে বাস্তবায়ন করার জন্য মিছিল, সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে যেভাবে শপথ এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করছে তাতে আসন্ন সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।