চীনের থাংশান শহরে সর্বপ্রথম মৃৎশিল্পের জন্ম হয়। আর এ কারণে এ শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। চীনের পেইচিং শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এই শহরের অবস্থান। এখানকার পথে-প্রান্তরে, পর্যটনকেন্দ্র ও পার্কগুলোতে মৃৎশিল্পের নানা শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশেও এই শিল্পের ব্যবহার সেই আদিকাল থেকে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে মাটির তৈরি হাড়ি-পাতিল, কলসি, থালা, বাটি, ফুলের টব, ফুলদানি, ব্যাংক, খাবার টেবিল, খেলনা, সৌখিন সামগ্রীসহ নানা জিনিসপত্রের ব্যবহার হয়। মাটির তৈরি এই শিল্পকর্মের সাথে মিশে আছে গ্রামীণ বাংলার হাসি-কান্না ও সুখ-দু:খের ইতিহাস। এক সময় মৃৎশিল্পীরা তাদের এই শৈল্পিক প্রতিভার উপর ভিত্তি করে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তুলেছিলেন।
আবহমান বাংলায় প্রাচীন কাল থেকেই মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দু সম্প্রদায়ের পাল বর্ণের লোকেরা। পালরা মাটি দিয়ে কঠোর পরিশ্রমে সুনিপুণ হাতে তৈজসপত্র তৈরির মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। আশির দশকের দিকেও গ্রামের মানুষেরা মাটির তৈর বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি, সরা, কলস, বাসন, বদনা, মুড়ি ভাজার খোলাসহ গৃহস্থালির নানা বস্তু ব্যবহার করতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে আর আধুনিকতার চাকচিক্যে মৃতশিল্প আর কুমার পেশাটি তার শিকড় হারাতে বসেছে। এখন কুমাররা মাটির তৈরী দইয়ের পাতিল, নার্সারির ফুল ফলের টব এবং সাধারণ কিছু গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি বানানোর কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে অনেকে কুমার থেকে গেলেও বেশিরভাগই জড়িয়ে পড়েছেন অন্য পেশায়।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে কুমাররা এখন হাত চালিত চাকের পরিবর্তে ব্যবহার করেন মোটর চালিত চাক। প্রতিদিন সকাল থেকে নারীদের সুনিপুর হাতের ছোঁয়ায় তৈরি করা হয় এসব শিল্প। এখানকার প্রতিটি ঘরে মাটির তৈরি হাড়ি-পাতিল, কলসি, থালা, বাটি, ফুলের টব, ফুলদানি, খেলনা, সৌখিন সামগ্রীসহ নানা জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। প্রায় ১২ ঘন্টা রোদে শুকানোর পর এসব সামগ্রী পুড়ানো হয় চুলা বা পাজায়। চুলার আগুনে পুড়ে পুড়ে মৃৎ শিল্পগুলো ফিরে পায় স্থায়িত্ব আর সৌন্দর্য। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে মাটির তৈরি জিনিসপত্র কম দামে কিনে বিভিন্ন হাটে বিক্রি করেন।
তবে সূদুর অতীতে দেশের অর্থনীতি চাঙা রাখতে মৃৎশিল্পের বিকল্প পথ সে সময় ছিল না। কুমারপাড়ার মেয়েরা ব্যস্ততায় দম ফেলার সময় পেতো না। কাঁচামাটির গন্ধ ভেসে আসতো চারদিক থেকে। হাট-বাজারে মাটির তৈজসপত্রের চাহিদা ছিল অনেক।
আজকাল বৈশাখী মেলা, গ্রামীণ কিছু মেলায় ঘুরতে গেলে দেখা মিলে পোড়ামাটির নানাবিধ কাজ, গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পুতুল, খেলনা, প্রতিমা, শো-পিসসহ অসংখ্য তৈজসপত্র। এছাড়াও মৃৎশিল্প জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘরে দেখা যায় সে সময়ের বাংলার কুমারপাড়ার চিত্র।
ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি এখনো আকড়ে ধরে আছে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার নগরঘাটার কুমারপাড়া এলাকার কয়েকটি পরিবার। গ্রামটিতে ঢুকতেই রাস্তার পাশে সারি সারি কাঁচা, আধা-কাঁচা মাটির তৈরি পাত্র রোদে শুকাতে দেখা যায়। তবে, প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক, স্টিল, মেলামাইন, চিনামাটি, সিলভারসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থের তৈরি হাড়ি-পতিল, খেলনা, সৌখিন জিনিসপত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ধ্বংসের মুখে এই প্রাচীন মৃৎশিল্প। তবে কেউ কেউ বাপ-দাদার স্মৃতি হিসেবে এখনো ধরে রেখেছেন এই পেশা। কুমার পরিবারের নারীরা মৃৎশিল্পের নানা দ্রব্য তৈরিতে সাহায্য করেন। নারীদের সুনিপুণ দক্ষতা এবং কুশলতার ছোঁয়ায় এখনও টিকে আছে এই শিল্প। তবে বর্তমানে এ শিল্পের দুর্দিন চলছে। অনেকেই আবার পন্যের ধরন পাল্টিয়ে ইট তৈরি করছেন। ইটভাটা স্থাপন ও ইট প্রস্তুত আইন ২০১৩-এর ৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে কাঠ ব্যবহার করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে দেশব্যাপি ইটভাটাগুলোতে দেদারছে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কুমার পাড়ায়ও এখন ইট তৈরির ফলে বেশি কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে এসব কাঠ সংগ্রহ করায় হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ।
ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে বর্তমান চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে মাটির সৌখিন জিনিসপত্র তৈরি আর এই সৌখিন জিনিসপত্র তৈরির জন্য তাদের বিভিন্ন উপকরণসহ প্রশিক্ষণ দরকার। তা না হলে অচিরেই আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে এক সময়ের অর্থনীতির চালিকা শক্তি মৃৎশিল্প। মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কুমার এবং পালদের আধুনিকতার ছোয়ায় ফিরিয়ে আনতে সহজ শর্তে ঋণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে আধুনিক মানের শিল্পকর্ম বিদেশে রপ্তানী হবে এবং দেশীয় শিল্পের সমৃদ্ধি ও হারানো জৌলুস ফিরে আসবে।
সংবাদ শিরোনাম:
বিজ্ঞাপন দিন
বিলুপ্তির পথে মৃৎ শিল্প
- এস এম আশরাফুল ইসলাম
- আপডেট সময়: ০২:৫২:৪৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ মার্চ ২০২৪
- ২০৪ বার পড়া হয়েছে
ট্যাগস:
জনপ্রিয় সংবাদ